প্রত্যাহারের পর জেলেকে প্রাণনাশের হুমকি দিলেন আরডিসি নাজিম

সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগানের বাড়িতে মধ্যরাতে হানা এবং তাকে তুলে নিয়ে জেল-জরিমানা দেওয়ার ঘটনায় প্রত্যাহার হওয়া জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার (আরডিসি) নাজিম উদ্দিন এলাকা ছাড়ার আগে এক জেলেকে র‌্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার ও প্রাণনাশের হুমকি দিয়েছেন।

জানা যায়, মঙ্গলবার (১৭ মার্চ) দুপুরে বিশ্বনাথ দাস নমো (৩৬) নামের এক জেলেকে জেলা প্রশাসকের (ডিসি) বাংলোতে ডেকে নিয়ে র‌্যাব দিয়ে গ্রেপ্তার ও প্রাণে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছেন তিনি। এতে মানসিক আঘাত পেয়ে বিশ্বনাথ দাস কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।

বিশ্বনাথ দাস জানান, মঙ্গলবার দুপুরে জামিনে কুড়িগ্রাম কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর বাইরে আসলে তাকে ডিসি বাংলোতে ডেকে নিয়ে যান নাজিম উদ্দিন। সেখানে গণমাধ্যমে কোনো কিছু বলা যাবে না মর্মে তার ভিডিও ধারণ করা হয়। এসময় তাকে বলা হয়, তোমাকে র‌্যাব খুঁজছে। তুমি যেন ক্রসফায়ারে না পড়, এজন্য আপাতত তুমি কুড়িগ্রামের বাইরে গিয়ে থাক।

এরপর তাকে কুড়িগ্রামের খলিলগঞ্জ এলাকায় নিয়ে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখান থেকে বিশ্বনাথ দাস কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের ভর্তি হন।

কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের সুপারিন্টেনডেন্ট ডা. জাকিরুল ইসলাম বলেন, মানসিকভাবে আঘাত পাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন বিশ্বনাথ দাস। তাকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে তিনি যদি মানসিকভাবে আরো আঘাত পান, সেটি তার জন্য বিপজ্জনক হবে।

বিশ্বনাথ দাসকে স্বাভাবিক রাখতে পরিবারের লোকজনকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বিশ্বনাথ দাসের স্ত্রী শোভা রানী দাস বলেন, মধ্যরাতে আমার স্বামীকে বাড়ি থেকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন। তার সঙ্গে ৭ থেকে ৮ জন থাকলেও, কোন পুলিশ সদস্যকে আমি দেখিনি।

তিনি আরও বলেন, সেসময় আমি ও আমার ছেলে অনেক কেঁদেছি, কিন্তু নাজিম উদ্দিন আমাদের কান্না শুনেননি। স্বামী জেলে থাকায় আমাদের অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে।

এদিকে, নাগেশ্বরী উপজেলার অপর মৎস্যজীবী খালেকুজ্জামান মজনু ৬ মাসের দণ্ডাদেশ শেষ হওয়ার পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি জামিন লাভ করেন।

মোবাইলে যোগাযোগ করা হলে মজনু জানান, তার স্বজনরা সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের সঙ্গে যোগাযোগ করায় তার নির্দেশে ২৭ ফেব্রুয়ারি জামিন পান তিনি। জামিনের পর তাকে ডেকে নিয়ে কাগজে মুচলেকা লিখে সাক্ষর নিয়ে ডিসি বলেন, বিলের লিজ নিয়ে যেন কোন ধরনের মাখামাখি করা না হয়।

আমি আর ভয়ে বিলের লিজ নিয়ে ছুটাছুটি করি নাই। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ডিসি ম্যাডাম তার পছন্দের লোককে সেই লিজ পাইয়ে দিয়েছেন, বলেন তিনি।

ধরে নেওয়ার পর সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন তাকে ও বিশ্বনাথকে বেদম মারধর করেছিলেন বলেও জানিয়েছেন মজনু।

বিশ্বনাথ দাসের আইনজীবী অ্যাডভোকেট হুমায়ুন কবীর বলেন, সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় বিশ্বনাথ দাস ও খালেকুজ্জামান মজনুকে মোবাইল কোর্টে সাজা দেন সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন। যদিও ১৮৮ ধারায় সাজা প্রদানের সাকুল্য ক্ষমতা ১ মাস থেকে ৬ মাস পর্যন্ত, কিন্তু আইনের ব্যত্যয় ও স্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটিয়ে বিশ্বনাথ দাসকে ১ বছর সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া অপর ধারায় ১১ মাস ১ দিন সাজা দেন।

এসব ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রতিশোধ নিতেই মধ্যরাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

এ বিষয়ে নাজিম উদ্দিন বলেন, মৎস্যজীবী বিশ্বনাথ দাস ও খালেকুজ্জামান মজনুকে আমি মারধর করিনি। জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন স্যারের নির্দেশে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়েছে। সরকারি কাজে বাঁধা প্রদানের অপরাধে বিধি মোতাবেক এই দুই ব্যক্তিকে পেনাল কোডের ১৮৮ ও ১৮৯ ধারায় সাজা প্রদান করা হয়।

জামিনে কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্বনাথ দাস নিজেই আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। আমি গাড়িতে করে তাকে কোথাও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে আসিনি, বলেন তিনি।

যা কিছু হয়েছে, সবকিছুই জেলা প্রশাসনের স্বার্থে সাবেক ডিসি সুলতানা পারভীনের নির্দেশে হয়েছে, এমনটি বলে তিনি অনুরোধ করেন তাকে নিয়ে আর লেখালেখি না করতে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে নাগেশ্বরী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রওশন কবির বলেন, আমি ২৬ ফেব্রুয়ারি থানাতেই ছিলাম। কিন্তু ওই দিন কোনো মোবাইল কোর্ট দিনে কিংবা রাতে পরিচালনা করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। এমনকি আমার থানার কোনো পুলিশ সদস্যও মোবাইল কোর্টে পাঠানো হয়নি।

নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) নুর আহমেদ মাসুম বলেন, আমি আপনার মুখেই প্রথম জানতে পারলাম ২৬ ফেব্রুয়ারি নাগেশ্বরীতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছেন সাবেক আরডিসি নাজিম উদ্দিন। কিন্তু আমার অফিসে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই এবং আমি এ বিষয়ে কিছুই জানি না।

তবে তিনি বলেন, গিরাই নদী বিল নিয়ে মৎস্যজীবীদের মধ্যে থেকে জেলে বিশ্বনাথ দাস নামে এক ব্যক্তি হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেছেন। কেন এবং কী অপরাধে ওই দুই ব্যক্তিকে মধ্যরাতে তুলে নিয়ে গিয়ে মোবাইল কোর্টে সাজা প্রদান করা হয়েছে, তা হয়তো জেলা প্রশাসকের কার্যালয় ভালো বলতে পারবে।

সদ্য প্রত্যাহার হওয়া কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনের মোবাইলে একাধিকবার কল করেও তিনি না ধরায় এ বিষয়ে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

প্রসঙ্গত, জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন একটি পুকুর সংস্কার করে নিজের নামে নামকরণ করতে চেয়েছিলেন। সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম রিগান বিষয়ে নিউজ করার পর থেকেই তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন ডিসি। এছাড়া, সম্প্রতি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নিয়োগ নিয়ে ডিসি সুলতানা পারভীনের অনিয়ম নিয়েও প্রতিবেদন তৈরি করেন আরিফুল। এসময় একাধিকবার তাকে ডিসি অফিসে ডেকে নিয়ে হুমকি দেওয়া হয়। এ ঘটনার জেরে গত ১৩ মার্চ মধ্যরাতে সাংবাদিক আরিফের বাসায় হানা দিয়ে তাকে তুলে ডিসি অফিসে এনে নির্যাতন করা হয়। এরপর আধা বোতল মদ ও দেড়শ গ্রাম গাঁজা পাওয়ার অভিযোগ এনে ওই রাতেই তাকে এক বছরের কারাদণ্ড দিয়ে জেলে পাঠায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। পরে রোববার তিনি জামিনে মুক্তি পেয়েছেন।

এ ঘটনার পর ডিসিসহ সোমবার আরডিসি নাজিমউদ্দীনসহ দুই সহকারী কমিশনারকে প্রত্যাহার করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীনকে প্রত্যাহার করে নতুন জেলা প্রশাসক হিসেবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

আপনি আরও পড়তে পারেন